কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠায় মেয়র অ্যাডামসের সহায়তার প্রতিশ্রুতি ।। বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলাদেশ সোসাইটির কর্মকর্তারা অভিষিক্ত
বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবসে বর্ণাঢ্য আয়োজনে ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিষিক্ত হলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের ‘আমব্রেলা সংগঠন’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সোসাইটি ইনক’র নব নির্বাচিত কমিটির কর্মকর্তারা। সেই সাথে সোসাইটি পালন করে বাংলাদেশের ৫৪তম বিজয় দিবস। এ উপলক্ষ্যে গত ১৬ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় উডসাইডের তিব্বত কমিউনিটি সেন্টারে মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঠান্ডা আর হালকা বৃষ্টি-বাদলার মধ্যেও অনুষ্ঠানে প্রবাসে বসবাসকারী বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও সর্বস্তরের হাজারো প্রবাসী বাংলাদেশী সপরিবারে অংশ নেন। ফলে অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নিউইয়র্ক সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস।
‘লাল-সবুজের’ বাংলাদেশের বিজয় দিবসের আমেজে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয় দেশের বীর শহীদদের, সম্মান জানানো হয় ৫০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সোসাইটির প্রয়াত সকল কর্মকর্তা সহ সাবেক কর্মকর্তাদের। এদিকে বিগত সরকারের কর্মকান্ডের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্ব চলাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-কর্মীর প্রতিবাদ এবং বিএনপি দলীয় নেতা-কর্মীর পাল্টা প্রতিবাদে অনুষ্ঠান স্থলে উত্তেজনার সৃষ্টি দেয়। তাতে অভিষেক অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য খানিকটা ¤øান হয়ে যায়। তবে কর্মকর্তাদের অনুরোধে পরবর্তীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। মেয়র অনুষ্ঠানস্থলে আসার আগেই এই ঘটনা ঘটে।
কয়েকটি পর্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিলো বাংলাদেশ সোসাইটি পরিচালিত দুটি বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা। এই পর্বে বিজয়ের ইতিহাসের ভিত্তিতে রচিত কবিতা, গান ও নাচ পরিবেশন করে শিক্ষার্থীরা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে। দ্বিতীয় পর্বে ছিলো নবনির্বাচিত কর্মকর্তাদের শপথ গ্রহণ, তৃতীয় পর্বে ছিলো আলোচনা এবং তৃতীয় পর্বে ছিলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশভোজ। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হুদা, নিউইয়র্ক ষ্টেট সিনেটর জন সি ল্যু, ষ্টেট অ্যাসেম্বলীওম্যান জেনিফার রাজকুমার। উল্লেখ্য, গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সোসাইটির দ্বি-বার্ষিক (২০২৫-২০২৬) নির্বাচনে ‘সেলিম-আলী’ প্যানেলের প্রার্থীরা বিপুল ভেটে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে তাদেও একমাত্র প্রতিদ্ব›িদ্ব ছিলেন ‘রুহুল-জাহিদ’ প্যানেল।
সোসাইটির বিদায়ী সভাপতি আব্দুর রব মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলওয়াত করেন অভিষিক্ত সমাজ কল্যাণ সম্পাদক জামিল আনসারী, গীতা পাঠ করেন সোসাইটির বিদায়ী কমিটির শিক্ষা ও স্কুল বিষয়ক সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্য। এরপরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করার পর অনুষ্ঠানে ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহত এবং মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে সোসাইটির যেসকল কর্মকর্তা ও সদস্যসহ যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর নতুন কমিটির সকল কর্মকর্তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান প্রধান নির্বাচন কমিশনার এডভোকেট জামাল আহমেদ জনি। এ সময় নির্বাচন কমিশনের সদস্য যথাক্রমে আব্দুল হাকিম মিয়া, আনোয়ার হোসেন, আব্দুল মান্নান, মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, মাহবুবুর রহমান বাদল, আহবাব চৌধুরী খোকন উপস্থিত ছিলেন। এই পর্ব পরিচালনা করেন মাইনুল উদ্দিন মাহবুব।
অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধান অতিথি মেয়র এরিক অ্যাডামস অভিষিক্ত কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানান এবং সোসাইটির প্রত্যাশা ‘কমিউনিটি সেন্টার’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তার প্রতিশ্রæতি দেন। এছাড়াও সোসাইটির সকল কাজে সিটির সহযোগিতা অব্যাহত থাকার কথাও জানিয়ে মেয়র অ্যাডামস আরো বলেন, তবে এজন্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এদিকে সিটি মেয়র অ্যাডামসের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানস্থল প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে। অনুষ্ঠানে মেয়র অ্যাডামকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বাংলাদেশ সোসাইটির কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানে মেয়র বাংলাদেশ সোসাইটিকে একটি সাইটেশন প্রদান করেন। এরপর নবনির্বাচিত কর্মকর্তারা মেয়রের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন। অভিষেক পর্ব শেষে অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ, নতুন সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম ও সাধারণ মোহাম্মদ আলী এবং সিটি মেয়রের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মীর বাশার।
ষ্টেট সিনেটর জন ল্যু অতীতর মতো সামনের দিনগুলোতেও বাংলাদেশী কমিউনিটির পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। স্টেট অ্যাসেম্বলীওম্যান জেনিফার রাজকুমার সিটি, স্টেট, ফেডারেল পর্যায়ের সকল নির্বাচনে কাজ করার আহবান জানান।
অভিষেক অনুষ্ঠানের পরে নতুন কমিটির আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন নবনির্বাচিত সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম। এই পর্ব পরিচালনা করেন নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী। এসময় সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম আজিজ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এডভোকেট জামাল আহমেদ জনি, বিদায়ী সভাপতি আব্দুর রব মিয়া, সিনিয়র সহ সভাপতি মহিউদ্দিন উদ্দিন দেওয়ান, বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী, অভিষেক ও বিজয় দিবস আয়োজন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ফারহানা চৌধুরী, বিদায়ী সহ সভাপতি ফারুক চৌধুরী, সাবেক সভাপতি আখতার হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ হোসেন খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম এবং সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুর রহিম হাওলাদার মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন। এই পর্বে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন বিদায়ী কোষাধ্যক্ষ নওশেদ হোসেন, অভিষিক্ত কোষাধ্যক্ষ মফিজুল ইসলাম ভুইয়া রুমী।
পর্বে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের তাৎপর্যসহ সাংগঠনিক আলোচনা স্থান পায়। আলোচনার এক পর্যায়ে সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম তার বক্তব্যে বলেন, বিজয় দিবসে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আমরা ৩ বার বিজয় অর্জন করেছি ৩ রকমের। বলেন, একটা ৪৭ সালে, এটা ৭১ সালে, একবার এরশাদের সময় এবং ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট। তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময় আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমাদেরকে সেবা দাসের একটি গোষ্ঠিতে পরিণত করা হয়েছিলো। সেখান থেকেই বিজয় লাভ করেছি। ফখরুল আলম বলেন, অতীতে যারা লুন্টন করেছে, নারী নির্যাতন করেছে, গুম হত্যা করেছে, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের এই বিজয়। তিনি বলেন, এসব অনিয়ম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের শপথ নিতে হবে, তাদের চেহারা তুলে ধরতে হবে।
ফখরুল আলমের এমন বক্তব্যের সময় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ‘ভুয়া ভুয়া’ বলতে থাকেন এবং প্রতিবাদের ভাষায় হৈচৈ, চিৎকার, চেচামেচি শুরু করেন। কেউ কেউ মঞ্চের দিকে তেড়ে আসেন। এদিকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র কয়েকজন নেতা-কর্মী। ফলে অনুষ্ঠানস্থলে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঘটে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা। অনুষ্ঠানস্থলে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খল পরিবেশ। এই পর্যায়ে নব নির্বাচিত সভাপতি আতাউর রহমান সেলিমসহ সোসাইটির কর্মকর্তারা মাইক নিয়ে পরিবেশ শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং অনুষ্ঠানের স্বার্থে ক্ষমাও প্রার্থনা করেন। বলেন, এটা সোসাইটির অনুষ্ঠান, কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রাম না, এটা আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠান। পরবর্তীতে মেয়র এরিক অ্যাডামস আসার খবরে পরিবেশ শান্ত হয়। সবশেষে নৈশভোজের পাশাপাশি চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক সম্পাদক অনিক রাজের পরিচালনায় এই পর্বে কালা মিয়া সহ প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
আরো উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে অভিষিক্ত সোসাইটির কর্মকর্তারা হলেন: সভাপতি- আতাউর রহমান সেলিম, সিনিয়র সহ সভাপতি- মহিউদ্দিন দেওয়ান, সহ সভাপতি- কামরুজ্জামান বকুল, সাধারণ সম্পাদক- মোহাম্মদ আলী, সহ সাধারণ সম্পাদক- আবুল কালাম ভুইয়া, কোষাধ্যক্ষ- মফিজুল ইসলাম ভুইয়া (রুমি), সাংগঠনিক সম্পাদক- ডিউক খান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক- অনিক রাজ, জনসংযোগ ও প্রচার সম্পাদক- রিজু মোহাম্মদ (বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত), সমাজ কল্যাণ সম্পাদক- জামিল আনসারী, সাহিত্য সম্পাদক- মোহাম্মদ আখতার বাবুল, ক্রীড়া ও আপ্যায়ন সম্পাদক- আশ্রাব আলী খান লিটন, স্কুল ও শিক্ষা সম্পাদক- মোহাম্মদ হাসান (জিলানী), কার্যকরি সদস্য- মোহাম্মদ সিদ্দিক পাটোয়ারী, হারুন চেয়ারম্যান, আবুল কাশেম চৌধুরী, জাহাঙ্গীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মুনসুর আহমদ ও হাছান খান।
অভিষেক ও বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘প্রত্যাশা’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। এটি সম্পাদনা করেন সোসাইটির বিদায়ী সাহিত্য সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ। ব্যবস্থাপক সম্পাদক ছিলেন প্রচার ও গণসংযোগ সম্পাদক রিজু মোহাম্মদ। সহ-সম্পাদক ছিলেন নতুন কমিটির সাহিত্য সম্পাদক মো. আকতার বাবুল।